সম্রাট চারঘাট প্রতিনিধিঃ

রাজশাহীর চারযাট উপজেলার পাটিয়াকান্দি গ্রামের এক সাধারণ মানুষ, যিনি হয়ে উঠেছিলেন গ্রামের অসংখ্য মানুষের পরম ভরসার ব্যক্তি।জানায়ায, পাটিয়াকান্দির ইতিহাসে যদি দশজন ব্যক্তি থাকে তার মধ্যে নিঃসন্দেহে তিনি একজন। স্বর্গীয় রবি ডাক্তার কে মানুষের চিরকাল মনে রাখতে হবে।

তাঁর আসল নাম রবীন্দ্রনাথ সরকার রবি, কিন্তু “রবি ডাক্তার” নামেই পরিচিত ছিলেন প্রতিটি মানুষের কাছে, প্রতিটি অসহায় মুখের আশার আলো, । তিনি ছিলেন সৎ, পরিশ্রমী, বিনয়ী এবং সর্বোপরি মানবসেবায় আত্মনিবেদিত একজন চিকিৎসক। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের কোনো উচ্চতর ডিগ্রি না থাকলেও তাঁর অভিজ্ঞতা, আন্তরিকতা এবং অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তোলার এক অপূর্ব ক্ষমতা ছিল। তাঁর হাতে যেন লুকিয়ে ছিল এক নিঃশব্দ যাদু যেটা ছিল তাঁর মমতা, সাহস আর ত্যাগের শক্তিতে ভরা। তিনি রোগী দেখতেন না কেবল শরীরের চোখ দিয়ে নয় বরং হৃদয়ের চোখে তিনি বুঝতেন কার মায়ের জ্বর, কার সন্তানের পেটব্যথা, কার স্ত্রীর প্রসবব্যথা আর কার বাবার নিঃশ্বাসের সঙ্গে লড়াই করছেন সকলের পাশে থাকতেন তিনি।

ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির সময় তিনি নওগাঁ জেলার আত্রাই এলাকায় বসবাস করতেন। ছোটবেলা থেকেই চিকিৎসক হওয়ার এক অদম্য ইচ্ছা ছিল তাঁর। কিন্তু দারিদ্র্য ছিল সেই স্বপ্নের পথে বড় বাধা। ধনী পরিবারের সন্তান না হওয়ায় প্রথাগত উচ্চশিক্ষা নিতে পারেননি। তবুও হার মানেননি তিনি। রাজশাহীতে থেকে প্যারামেডিকেল কোর্স করেন এবং এরপর নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটি নেন চিকিৎসা সেবাকে পেশা নয়, মানবসেবা হিসেবে গ্রহণ করা।

তিনি বসবাস শুরু করেন রাজশাহী জেলার চারঘাট উপজেলার পাটিয়াকান্দি গ্রামে, যেখানে ছিল না কোনো চিকিৎসক, ছিল না চিকিৎসার কোনো সঠিক ব্যবস্থা। এখান থেকেই শুরু হয় রবি ডাক্তারের যাত্রা, যা কেবল তাঁর একার নয়, ছিল হাজারো মানুষের আরোগ্যের গল্পের সূচনা।

বাসা থেকেই শুরু করেন চিকিৎসা সেবা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের দশটিরও বেশি গ্রামে। নির্জন এক ঘরে, গরিব মানুষের কান্না-ভেজা মুখের পাশে বসে শুরু হয় এক নিরব বিপ্লব।

রবি ডাক্তার কোনোদিন সময়ের হিসাব করেননি, মজুরির কথা বলেননি, নিজের ক্লান্তি বুঝেননি। দিন-রাত, ঝড়-বৃষ্টি কিংবা গভীর অন্ধকার— কারো অসুস্থতার খবর পেলেই তিনি ছুটে যেতেন রোগীর কাছে শুধুই “চিকিৎসার দায়িত্ব” রোগী ছিল তার আত্মার কাছের মানুষ, তার সেবার প্রতিচ্ছবি।

তিনি কখনোই অর্থলোভ করেননি। গরিব-দুঃখীদের জন্য তাঁর দরজা সবসময় খোলা ছিল। বিনা পারিশ্রমিকে চিকিৎসা, নিজ খরচে ওষুধ কিনে দেওয়া কিংবা পথে বসা মানুষের মাথায় হাত রেখে সাহস জোগানো সবটাই ছিল তাঁর প্রতিদিনের স্বাভাবিক কাজ। তিনি গরিব ছিলেন, কিন্তু তাঁর মন ছিল রাজাধিরাজের মতো উদার।

১৯৯৬ সালে যখন পাটিয়াকান্দি বাজার তৈরি হয়, তখন রবি ডাক্তার সেখানে একটি ছোট ধোব দোকান খুলে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করেন। সেই ছোট ধোব দোকানটাই হয়ে ওঠে গ্রামের একটি সহায়কেন্দ্র যেখানে শুধু ওষুধ নয়, মেলে পরামর্শ, আশ্বাস আর ভালোবাসার মমতা। পশু-পাখির প্রতিও তাঁর ছিল অগাধ ভালোবাসা। গরু-ছাগল এমনকি পথের কুকুর অসুস্থ হলে তিনি সাধ্যমতো সেবার চেষ্টা করতেন।

রবি ডাক্তার শুধু একজন গ্রাম্য চিকিৎসক ছিলেন না — তিনি ছিলেন এক আদর্শ, এক আলোর মশাল। তাঁর চিকিৎসা ও আচরণে ছিল এমন এক মানবিক ছোঁয়া, যা মানুষকে শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও সুস্থ করে তুলত। গ্রামের মানুষের মুখে কোন এক কারণে ফেরে তাঁর প্রশংসা ঝড় উঠেছে কয়েকদিন থেকে। ১৯৯৬ সালে আমি জন্মগ্রহণ করছে তাঁর হাত থেকে অনেক ওষুধ খেয়েছি। শুধু আমি না, আমার ভাই-বোন, মা-বাবা, দাদা-দাদি। শুধু আমার পরিবার না গ্রামে যারা ২০১৮ সালের আগে জন্মগ্রহণ করেছেন তারা প্রায় সকলেই তার কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়েছি। আমি নিজেকে ধন্য মনে করি কারণ তার মত ডাক্তারের সেবা আমি পেয়েছি। আমি গর্বের সঙ্গেই বলতে পারি “আমারও ডাক্তার ছিলেন রবি ডাক্তার।”

২০১৮ সালে তিনি আমাদের ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমান। তাঁর চলে যাওয়া যেন একটি যুগের অবসান। কিন্তু মানুষ চিরকাল বাঁচে না — তবুও কিছু মানুষ তাঁদের কর্মে ও ভালোবাসায় বেঁচে থাকেন অনন্তকাল। রবি ডাক্তার ঠিক তেমনই একজন মানুষ, যিনি আমাদের কাছে কেবল একজন ডাক্তার ছিলেন না — ছিলেন ভরসা, ভালোবাসা আর নিঃস্বার্থ সেবার এক প্রতীক।

রবি ডাক্তার নেই, কিন্তু তাঁর স্মৃতি, আদর্শ রয়ে গেছে তাঁর হাসিমুখ, নিরলস সেবা, ঝড়বৃষ্টির মধ্যেও ছুটে যাওয়া পায়ের ধ্বনি এখনও যেন বাজে পাটিয়াকান্দির বাতাসে। তার প্রতিদান হয়তো আমরা কেউ দিতে পারবো না।___________(I wanted to write a lot but I couldn’t. I’m sorry.) আপনি চলে গেছেন, কিন্তু আপনার আলো থেকে যাবে অনন্তকাল।
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে স্মরণ করছি সেই মানুষটিকে, নাম না জানা অসংখ্য হৃদয়ের চিকিৎসক। যিনি ছিলেন আমাদের ভালোবাসার রবি ডাক্তার।